ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ও একটি করণীয়

ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ও একটি করণীয়

ছাত্রলীগ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। দেশের রাজনীতি, সমাজ সংস্কার, ছাত্র অধিকার আন্দোলনে এর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। এটি সাধারণ সত্য এবং এই কথা সবাই জানে, সর্বজন স্বীকৃত।

ঐতিহ্যবাহী সংগঠন হিসেবে এর সদস্যদেরও রয়েছে একটা অহংবোধ, থাকাটাই স্বাভাবিক। জন্মলগ্ন থেকে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন গুলোর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল এই সংগঠন, পাকিস্তানী শাসককুলের আতংক হিসেবে মূর্তমান হয়েছিল কঠোর সংগ্রাম চর্চার জন্য, অন্যায়ের নিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য।

ছয়দফা আর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথানে জোরালো ভূমিকার ফলে সত্তরের নির্বাচন আর বাঙ্গালীর মুক্তির সংগ্রামের দিন গুলোতে একক ভূমিকায় ও আপন মহিমায় জনমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া শত গৌরবের এই ছাত্র সংগঠন।

পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে বাংলার মানুষ যে লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল তাতে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অনন্য। সেই নিরিখে ছাত্রলীগের সদস্যদের অহংকার করার মত জায়গাতো রয়েছেই।

 

ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী

 

প্রশ্ন হলো অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে, ছাত্রলীগে ‘অনুপ্রবেশকারী’। সাম্প্রতিক দিন গুলোতে অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্নে উচ্চারিত হচ্ছে নানা কথা, নানা মত। কেউ বলছে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীদের কোনো স্থান নাই, কেউ বলছে ছাত্রলীগে কোনো অনুপ্রবেশকারী নেই আবার কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে বলছেন এম পি-মন্ত্রীদের সুপারিশেই ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীর সৃষ্টি হয়েছে।

স্বয়ং আওয়ামীলিগের সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরও অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এমনকি দলে অনুপ্রবেশকারীদের কোনো জায়গা নেই বলেও উচ্চারণ করেছেন। ফলে বুঝা যায় ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে।

 

 

কারা এই অনুপ্রবেশকারী?

সাধারণ অর্থে এখানে অনুপ্রবেশকারী বলতে বোঝানো হচ্ছে, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির ও বি এন পি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সদস্যদের, তারা অনুপ্রবেশ করছে ছাত্রলীগে। এই সংগঠনের সদস্যরা সুবিধা হাসিলের লক্ষ্যে ছাত্রলীগে প্রবেশ করছে বিশেষ ভান করে। যেহেতু যুদ্ধাপরাধের দায়ে জায়ামাতের নেতারা দণ্ডিত হওয়ার ফলে ছাত্রশিবির ছাপের মুখে আছে আর জ্বালাও পোড়ায়ের রাজনীতি করে বি এন পি ও ছাত্রদল বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনঠাসা তাই ছাত্রদল চেষ্টা করছে ছাত্রলীগের সাথে মিশে সুবিধা নিতে। তারা এই কাজ করতে গিয়ে নিজেদের ইতি পূর্বেকার রাজনৈতিক পরিচয় লুকাচ্ছে এবং ছাত্রলীগের পদ-পদিবী গ্রহন করছে।

অনুপ্রবেশের এই কাজটি করতে গিয়ে তারা কখনো কখনো আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের ব্যাবহারও করছে। আর আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধেও তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠছে, যদিও এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে সম্প্রতি অনুপ্রবেশের প্রশ্নটি আরো জোরালো হয়েছে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী অসুভ শক্তির সদস্যদের বড় বড় পদেও দেখা গেছে বলে অনেকে দাবি করছে।

অনুপ্রবেশের প্রকৃত কারণ কি?

অনুপ্রবেশের অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে মোটাদাগে এদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়;

প্রথমত, এখানে অনুপ্রবেশকারী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে বলা যায় spy বা secret agent। এর অর্থ হলো এটা কোনো স্বাভাবিক প্রবেশ বা যোগদান নয়। এখাবে অনুপ্রবেশকারীরা গোপনে প্রবেশ করে নিজেদের এক সময় ছাত্রলীগ দাবি করে এবং কৌশলে পদ-পদবি গ্রহন করে আবার কখনো কখনো প্রকৃত ছাত্রলীগের সদস্যদের চেয়েও দাপুটে হয়ে ওঠে।

ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীদের এই অংশটিই ভয়ংকর। তারা কখনো প্রকৃত ছাত্রলীগ হয়ে ওঠেনা। তারা সবসময় অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করে, সুযোগ বুঝে ছাত্রলীগকে বিপদে ফেলতেও দ্বিধা করেনা। তারা দলের মধ্যে অসুভ কাজে লিপ্ত হয় এবং দোষ হয় ছাত্রলীগের, নষ্ট হয় ছাত্রলীগের ঐতিহ্য। ফলে সাময়িক ছাত্রলীগের দলভারী হয়, দীর্ঘ মেয়াধি কোনো লাভ হয়না।

অন্যদিকে অনুপ্রবেশকারীদের আরেকটি দল প্রকৃতই ছাত্রলীগের নিতি-আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে নিজিকে সম্পৃক্ত করছে। এটা হতেই পারে, কারণ অনেকে আজ বুঝতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন গুলোর প্রকৃত অবস্থা। ছাত্রলীগ যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সংগঠন তারা তা অনুধাবন করছে।

আওয়ামীলীগ দীর্ঘ দিন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ফলে ইতিহাসের অনেক প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাই ইতিহাসের সত্য অনুধাবন করে অনেকে হয়তো ছাত্রলীগে প্রবেশ করছে, অন্য ছাত্র সংগঠন ত্যাগ করে। এটা ছাত্রলীগের জন্য অমঙ্গলের নয়।

প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ যাই হউক না কেন ছাত্রলীগ দলে ভারি হচ্ছে এটা সত্য। আর যেহেতু এর ভালো ও মন্দ দুটো দিক আছে, তাই নীতি নির্ধারকদের ভাববার সময় এসেছে কি ভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে ভাবনা কি?

যদিও সমস্যা হলো অসুভ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে, তবে দিনে দিনে এদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে অন্যদিকে ছাত্রলীগের নিতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েও অনেকে ছাত্রলীগে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। আর একটি বড় এবং ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক।

এখন আলোচনার বিষয় হলো নতুন এই বৃহৎ অংশের ছাত্রলীগে সম্পৃক্ত হওয়াকে দলের নীতি নির্ধারকরা কি ভাবে দেখবে বা কিভাবে দেখা উচিত।

যেহেতু আওয়ামীলীগ সরকার দেশের প্রভূত উন্নয়ণ সাধন করছে সাধারণ ছাত্ররা এর ছাত্র সংগঠনে যোগদান করবে বা প্রবেশ করবে বা অনুপ্রবেশ করবে, বাড়বে ছাত্রলীগের কলেবর। এই সম্পৃক্ততাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় নীতি নির্ধারকদের সেটাই সর্ব প্রথম ভাবা উচিত।

নীতি নির্ধারকদের ভাবা উচিত অনুপ্রবেশকারীদের কি শুদ্ধ করে দলের নীতি-আদর্শ চর্চায় সম্পৃক্ত করা যায় কিনা? যদি প্রকৃতই তা করা যায় তা হবে ছাত্রলীগের জন্য মঙ্গলকর। তবে তা হতে হবে সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যদিয়ে।

এর প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মত থাকতে পারে, সেটা হবে গবেষণার বিষয়, আলোচনার বিষয়। অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় কাজে সম্পৃক্ত করতে একটি গ্রহনযোগ্য ও কার্য্যকরী পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে নীতি নির্ধারকদের।

এখানে বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ তাঁর কার্য্যকলাপের মধ্যদিয়ে ইতিমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভবপর হচ্ছে। ফলে অনুপ্রাণিত হচ্ছে অনেকে। আর ছাত্রলীগকে আদর্শ সংগঠন হিসেবে তারা গ্রহন করছে। এটা আওয়ামীলীগের সফলতার একটি বড় দিক।

তদোপুরি, অসুভ অনুপ্রবেশকারীদের অংশটিকে সুদ্ধ করে দলের সাথে সম্পৃক্ত রাখা যায় কিনা ভাবা দরকার এইজন্য যে তারা যদি দলে অসুভ শক্তি হিসেবেই থেকে যায় তা ছাত্রলীগের জন্য মঙ্গল জনক হবে না। এইরূপ অনুপ্রবেশকারীরা যে দলের জন্য অমঙ্গলকর তা ইতিমধ্যে অনেকবার দেখা গেছে। দলের প্রতি অনুগত নয় এমন অনেকে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য। ছাত্রদের একটি বৃহৎ অংশ ছাত্রলীগের সমর্থক হিসেবে নিজেদের উল্লেখ করেই এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। যদি ধরেও নিই যে তারা ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলনা, শুধু সুবিধা মত আন্দোলন করার জন্য এই কৌশল নিয়েছিল। তারপরও এটাই সত্য যে তারা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ছাত্রলীগের বেশ ধরেছিল। তার অর্থ হলো এই, যে কোনো বড় আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্য ছাত্রলীগের প্রয়োজন। তাই এটি ছাত্রলীগের একটি অর্জন। ছাত্রলীগ এই অর্জনকেও কাজে লাগাতে পারে।

পাশাপাশি একথাও সত্য যে এখানে ছাত্রলীগের নামধারী অন্য সংগঠনের অনেক ছাত্র রয়েছে। তারা হয়তো অন্য কোনো সুবিধা বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এই বিষয়টিকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। ঢালাও ভাবে সবায়কে ছাত্রলীগে সম্পৃক্ত করাও যাবেনা।

ফলে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রবেশকারী বা অনুপ্রবেশকারী ছাত্রদের ছাত্রলীগে শুদ্ধরূপে সম্পৃক্ত করার কাজটি অনেক জটিল ও কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। তবে কঠিন এই কাজট করা দরকার এই জন্য যে, এই ছাত্ররাই এখানে জায়গা না পেয়ে অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হবে, আর তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হবে ছাত্রলীগের নীতি-আদর্শের বিপরীতে।

বর্তমান আওয়ামীলীগ নেতৃত্ত্বাধীন সরকার দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়ণশীল দেশের কাতারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, উন্নত দেশের কাতারে নেওয়ার জন্য লক্ষ্য স্থির করেছে। এটি একটি বৃহৎ আন্দোলন, আর এই আন্দোলনে সবার সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। সবাই হয়তো সম্পৃক্ত হবেনা, আর তারা নিশ্চয় কোনো বড় শক্তি হবেনা। কারণ উন্নয়নের বিপক্ষে কোনো বড় শক্তি থাকতে পারেনা।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সবাইকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল, একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া। আর তারাই পরাজিত হয়েছিল। দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার এই আন্দোলনেও সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হলে ছাত্রদের এই অনুপ্রবেশকারী অংশের ব্যাপারেও নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। তাদেরকে আদর্শহীনতার দিকে ঠেলে নাদিয়ে পরিশুদ্ধ করে দলে সম্পৃক্ত রাখতে পারাটাই হবে সফলতা।

ছাত্রলীগের সম্মেলন ও অনুপ্রবেশ

দলে অনুপ্রবেশ করেই ছাত্রলীগের পদ-পদবী পেয়ে যাওয়ার মোক্ষম সময় হলো ছাত্রলীগের সম্মেলন। এধরণের ঘটনার অভিযোগ উঠছে এবং উঠেছে। তাই পরিশুদ্ধতার কোনরূপ পদক্ষেপ না নিয়ে এইরূপ করলে বা অসতর্কতার ফলে এইরূপ হয়ে গেলে তা হবে দুঃখজনক, ছাত্রলীগের জন্য অমঙ্গলকর। যদিও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তা হওয়ার সম্ভবনা নেই, ছোট ইউনিট গুলোর ক্ষেত্রে এটা হওয়ার অভিযোগ থাকতে পারে।

 

ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী

 

তাই ছাত্রলীগের এবারের সম্মেলনে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, অর্থাৎ যদি ছাত্রলীগকে ভবিষ্যতে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে হয় বা ছাত্রলীগের আরো শক্ত অবস্থান তৈরি করার জন্য, তা চিন্তা করে এবং দেশের নির্বিগ্ন উন্নয়নের জন্য এই নির্দেশনা হওয়া উচিত অন্তর্ভূক্তিমূলক।

তবে বিশ্বাস ঘাতক ও অসুভ শক্তিকে অবশ্যই বাইরে রেখে। বোধকরি অসুভ শক্তির অনুপ্রবেশ ঠেকানো যতটুকু কঠিন, পরিশুদ্ধ করে দলে সম্পৃক্ত রাখাটা তার চেয়ে সহজ হবে। আর তা যদি সম্ভব হয় তার দীর্ঘ মেয়াধী সুফল পাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সুন্দর হবে আওয়ামীলীগ সরকারের অগ্রযাত্রার পথ।