সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মুহুর্মুহু আল্টিমেটাম প্রদান জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার বিষয়ে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়ার পরও এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা সে বিষয়েও সাধারণের মনে প্রশ্ন উঠেছে। কথা উঠছে তারা কি কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে কিনা। ইতিমধ্যে নানা মহল থেকে সেরকম অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এর পিছনে যে কিছু রাজনৈতিক দলের ইন্দন রয়েছে তার কিছু লক্ষণও দেখা গেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে একটি বড় সংখ্যক সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী অংশ গ্রহন করেছিল। তাই সব মহলে এটি গ্রহনযোগ্যতাও পেয়েছিল। প্রায় সকলেই এর যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করেছেন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ছাত্রদের এই আন্দোলনের প্রতি তাঁর মতামত সংসদে বলেছেন, যা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সন্তুষ্ট করেছিল।
তাই তারা অপেক্ষা করছে এই ভেবে যে নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ গ্রহন করবেন, সমস্যার সমাধান হবে। এমতাবস্তায়, রাস্তা অবরোধ ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আবার আন্দোলনের ডাক দেওয়া স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে আর পুরো আন্দোলনকেই প্রশ্ন বিদ্ধ করতে পারে এবং করছেও তাই।
গোড়াতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অসুভ শক্তির ছায়া
কোটা সংস্কার আন্দোলনের স্বতঃস্ফুর্ততার সুযোগ প্রথম থেকেই নিয়েছিল একটি অসুভ শক্তি। আন্দোলনের শুরুতেই রাস্তায় অবস্থান করে সাধারণের ভোগান্তি তৈরি করা অনেকটা রাজপথ দখলে নেয়ার মত, যা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা করেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এটা সাধারণ মানুষ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টিতে সঠিক বলে বিবেচিত নাও হতে পারে, এই আন্দোলনে শাহবাগ অবরোধকারীদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ফলে পুলিশ ও ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখী হতে হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা রাস্তা অবরোধ না করেও আন্দোলনকে তীব্র করে তুলতে পারত যদি সঠিক নেতৃত্ব থাকত।
কোটা সংস্কারঃ ভিসি’র বাড়ীতে আক্রমণ আন্দোলনের ঘৃন্যতম দিক
নেতৃত্বের দুর্বলতা থাকলে আন্দোলনকে স্বার্থান্বেসি মহল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সেটা ছিল স্পষ্ট। কোটা সংস্কারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলরের নুন্যতম সম্পর্ক নাই। তাঁর বাড়ীতে ন্যাক্কারজনক ভাবে হামলা-ভাংচুরও ছিলো তাই চরম অন্যায়, এবং নিঃসন্দেহে শাস্তির দাবি রাখে। আর এটা ছিলো কোটা সংস্কার আন্দোলনের বড় দুর্বলতা। হতে পারে প্রকৃত আন্দোলনকারীদের সাথে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নাই, কিন্তু এর দায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা এড়াতে পারেনা। কারণ তাদের ডাকা আন্দোলনের ফলেই এই ঘটনা ঘটেছিল। হয়তবা সুযোগ নিয়েছিল বিশেষ কোনো মহল।
সোস্যাল মিডিয়ার অপব্যাবহার ও ছাত্রীদের গভীর রাতে হল থেকে বেরিয়ে আসা
সাম্প্রতিক বছর গুলোতে সোস্যাল মিডিয়ার ব্যাবহার ও অপব্যাবহার করে অনেক আন্দোলন হয়েছে দেশে বিদেশে। আর কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুজি করেও এটির সর্বোচ্চ অপব্যাবহার হয়েছে। এই আন্দোলনে এমন কিছুই ঘটেনাই যে ছাত্রীদের মাঝ রাতে হলের গেইট ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে হবে, অথচ এখানে সহপাঠীর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে তাই করা হয়েছিল। এটাকে আন্দোলনের বড় সফলতা মনে করলেও প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছিল পরবর্তিতে।
সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীর পা কেটেছিল কাঁচের জানালায় লাথি মারার ফলে। আর সেটাকে ছাত্রলীগ নেত্রী কতৃক রগ কেটে দেয়ার গুজব ছড়িয়ে মাঝ রাতে হলের সামনে হাজার হাজার ছাত্র জড়ো করানো এবং হলের ভিতরে ছাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে সাময়িক পায়দা লুটা হয়তো সম্ভব হয়েছিল। তবে সেটাও পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল।
ফলে এই বিষয় গুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য বা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের জন্য যেমন অগৌরবের, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও অসম্মানের। আর এহেন কাজের জন্য যদি আরো বড় কোনো ঘটনা ঘটত তাঁর দায়ও আন্দোলনকারীদের নিতে হতো।
বর্তমানে বাংলাদেশের আইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো এবং তাঁর মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করলে শাস্তির ব্যাবস্থা রয়েছে। এক্ষেত্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির দায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী নেতৃত্বকেও যদি আইনের সম্মুখীন হয় তাতে বিস্মিত হবার কিছু নাই।
সবচেয়ে বড় কথা হল গুজব বা মিথ্যাচারের এই সংস্কৃতি একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্টির কর্মকান্ডের সাথে মিলে যায়। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্টির হয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থতি তৈরি করছে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও আত্মঘাতমূলক কর্মসূচী
আন্দোলনকারীদের সাম্প্রতিক কর্মসূচী সম্পূর্ণই আত্মঘাতী। যে চাকুরী পাওয়ার জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করছে, সে ছাত্ররাই যদি ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে, কী করে তারা নিজেদের চাকরীর জন্য তৈরি করবে? এছাড়া, তড়িগড়ি করে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও রাস্তা অবরোধের কর্মসূচী দেয়াটাও উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়। এতে যদি আবার আইন শৃঙ্খলার অবনতি হয়, নিশ্চয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে এবং এই আন্দোলনকে পুজি করে কারো যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনবে, আর এটাই স্বাভাবিক।
তাই সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনকে সাধারণ গতিতেই চলতে দেয়াই উচিত। অতি উৎসাহী হয়ে কেউ যদি কোনো বিশেষ মহলকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলা করার সুযোগ করে দেয় তা সমীচীন হবেনা বা কেউ যদি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক পায়দা লুটার অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করে তার দায়ও অনেকাংশেই আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বের দুর্বলতা হিসেবেই ববেচিত হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকারের সর্বোচ্চ মহলের উপর আস্থা
আন্দোলনকারী নেতৃত্বকে এটা বুঝতে হবে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এতটুকু হার্ডলাইনে যাওয়ার মত কোনো পরিস্থিতি এখনো হয়নাই, যেখানে সাম্প্রতিক দিন গুলোতে স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের ও অন্যান্য অনেক আন্দোলনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সদয় দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। আর ছাত্রদের আন্দোলনকে তার চেয়েও বেশী বিবেচনায় নিয়েছেন, জাতীয় সংসদে তাদের দাবি মানার ঘোষণা দিয়েছেন।
যেখানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, শেখ হাসিনার প্রতিটি সিদ্ধান্ত সর্ব মহলে প্রশংশিত হচ্ছে, সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উপর আস্থা রাখতে না পারা কিছুটা সন্দেহের জন্মতো দিতেই পারে। তাই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের এই দিকটির বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে, তারা যে ছাত্রদের প্রাণের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে তা ন্যায্য হলেও, কেউ যদি আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়ে এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তা তাদের অর্জনকে ম্লান করে ফেলতে পারে। আর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে আমলে না নেয়াটাও আন্দোলনকারীদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় খুব একটা বহন করেনা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও অপ্রয়োজনীয় আল্টিমেটাম
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা মুহুর্মুহু যে আল্টিমেটাম দিচ্ছে তাঁর খুব একটা প্রয়োজনিয়তা নাই। সাধারণ ছাত্ররা সফলতার সাথে এই আন্দোলনকে সরকারের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। আর সেখান থেকে তারা সমস্যার সমাধানের আশ্বাসও পেয়েছে। এটি আন্দোলনের সব চেয়ে বড় সফলতা। এর পর আবার আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন করার কোনো যৌক্তিকতা নেই, সত্যিকার অর্থে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও এটি পছন্দ করছেনা। তাই অতিউৎসাহী আন্দোলনকারীদের সর্বশেষ শাহবাগ আন্দোলন ও রাস্তা অবরোধকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ভালো চোখে দেখেনাই এবং অংশগ্রহনের স্বতঃস্ফুর্ততাও ছিল কম।
সর্বোপুরি, কোটা সংস্কার বিষয়ে বাংলাদেশের গণনন্দিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিকনির্দেশনা দেয়েছেন। সুতরাং এর একটি সুন্দর সমাধান হবে। যেখানে এর চেয়ে বড় বড় আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয় তিনি দক্ষতার সাথে সমাধান করে ইতিমধ্যে বিশ্বদরবারে প্রশংসা অর্জন করেছেন, সেখানে তাঁর নিজের সন্তান তুল্য ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা তিনি সদয় বিবেচনা করবেন এটিই স্বাভাবিক। তাই এই মুহুর্তে তাঁর উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখাটাই হবে প্রকৃত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের জন্য উত্তম কাজ।